সর্বশেষ বিজ্ঞান সংবাদ বিজ্ঞানবার্তা-র গুগল নিউজ চ্যানেলে।
ধরুন বন্ধুরা মিলে বেড়াতে বেড়িয়েছেন। আপনাদের মধ্যে এক বন্ধু খবর দিলো, যাওয়ার পথে একটা ঘন জঙ্গল পড়বে, কপাল ভালো থাকলে দু-একটা হরিণ, এমনকি বাঘও নজরে পড়তে পারে। অমনি আপনার মাথা সজাগ হয়ে গেলো, বাঘ দেখলে ঝপ করে কটা স্নাপশট তুলতে হবে। কিছু সময় পরে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, না বাঘ নয়, এ যাত্রায় হরিণই সই। কিন্তু হরিণের যা ছুট, আর সাথে আপনার পাঁচ বছর পুরোনো ক্যামেরার শাটার স্পিড এর যা হাল! না হলো না। খান কয়েক ছবি উঠলো বটে, কিন্তু দেখে হরিণকে চেনা দায়।
আসলে ক্যামেরায় গতিশীল কোনো বস্তুর ছবি যখন আমরা তোলার চেষ্টা করি, তখন সব থেকে গুরত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় শাটার স্পিড। খুব বেশি শাটার স্পিডে গতিশীল হরিণকে অনেকটা হরিণের মতোই মনে হয়। যাঁরা পেশাদার নন তারা ব্যাপারটা বুঝবেন। এমনকি আমরা যারা আনাড়ি, ঘরে শুয়ে অকারণে সিলিং ফ্যানের ছবি তুলি, তারাও খেয়াল করেছি চলমান ফ্যানের তিনটা ব্লেড পৃথকভাবে কখনো মুঠোফোন বন্দি করা যায় না। শাটার স্পিড বাড়ালে আলো খুব ছোট্ট মুহূর্তের জন্যই ক্যামেরায় ঢুকতে পারে। যার কথ্য নাম ‘শর্ট এক্সপোজার’ । ক্যামেরার ছিদ্র যদিও এর জন্য বড়ো করতে হয়, অর্থাৎ অ্যাপারচার বাড়াতে হয়। কারণ আমরা জানি ভালো ছবি তুলতে গেলে আলোর ঘাটতি হওয়া একদম চলবে না। সাধারণত এক সেকেন্ডের দশ হাজার ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে যদি আপনি কোন গতিশীল বস্তুর উপর আলো ফেলতে পারেন, তাহলে ছবি আর ঝাপসা হবে না। কম শাটার বিশিষ্ট ক্যামেরায় ছবি ঝাপসা আসে মূলত লক্ষ্য বস্তুর বিভিন্ন অংশ থেকে আলো আসার কারণে। শাটার স্পিড বাড়লে এই সম্ভাবনা বিশেষ থাকে না।
এ না হয়, আমাদের রোজকারের সিলিং ফ্যানের গতি, বা জঙ্গলের হরিণ ছানার গতি, তাতেই আমরা হিমশিম খাচ্ছি, আর বিজ্ঞানীরা দেখার চেষ্টা করছেন ‘কীভাবে ছোটে ইলেকট্রনগুলো?’ এতো ক্ষুদে আকারের এই কণা, যার ভর একটা প্রোটনের থেকে ১৮৩৭ গুণ হালকা, ছোটেও তীব্র গতিতে। তাদের আচরণও অদ্ভুত। ওদের গতিবিধিকে একবার পর্দায় ধরতে পারলেই কেল্লা ফতে!
কিন্তু কোটি টাকার প্রশ্ন হচ্ছে, কী করে ধরা দেবে ইলেক্ট্রনগুলো? সাধারণ ক্যামেরায় সব তো যান্ত্রিক শাটার, যত দামি ক্যামেরা হোক না কেনো, তা দিয়ে তো আর ইলেকট্রনের ছবি তোলা সম্ভব নয়। তার থেকেও বড়ো প্রশ্ন হলো ঠিক কতটা সময় পাওয়া যাবে তাদের ধরার জন্যে? এক কথায় উত্তর – অ্যাটোসেকেন্ড। হ্যাঁ, বড়োজোর এই অ্যাটোসেকেন্ড সময়ের মধ্যে ইলেকট্রনকে ধরতে পারলে ভালো, না হলে সে বেপাত্তা। কী সেই অ্যাটোসেকেন্ড?
সাধারণত কোনো দ্রুতগামী ঘটনা বোঝানোর জন্যে আমরা বলি, চোখের পলকে হয়ে গেলো। না চোখের পলক পড়তে অনেক সময় নেয় – এক সেকেন্ডে প্রায় চারবার পড়ে চোখের পলক। মানে প্রতি পলকের জন্যে বরাদ্দ মেরে-কেটে ১/৪ সেকেন্ড। আর এক সেকেন্ডকে একের পিঠে নটা শূন্য দিয়ে ভাগ করলে আমরা পাই ন্যানোসেকেন্ড। এবার ওই এক ন্যানো সেকেন্ডকে আবার একের পিঠে নটা শূন্য দিয়ে ভাগ করলে মেলে এক অ্যাটোসেকেন্ড। মানে এক কথায় বললে, এক সেকেন্ডকে একের পিঠে আঠারোটা শূন্য দিয়ে ভাগ করলে বা এক সেকেন্ডের ১০-১৮ ভাগের একভাগে যে সময় পাবো তার মধ্যেই ইলেকট্রনের ছবি তুলতে হবে। তবেই জানা যাবে তার গতিবিধি। ভাবছেন তো – কতটা ছোট এই অ্যাটোসেকেন্ড? তাহলে আপনাকে একটা ঘরোয়া পরীক্ষার উপায় বলি। আমরা সবাই জানি আলো খুব দ্রুত গতিতে চলে। এক সেকেন্ড প্রায় ৩ লাখ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। এবার আপনার ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে টর্চ জ্বালান। কতক্ষণ লাগবে অপর প্রান্তে পৌঁছাতে? বলবেন সাথে সাথেই। সেই মুহূর্ত টাই হাজার কোটি অ্যাটোসেকেন্ড সমান দীর্ঘ। এবারে বোধ হয় কিছুটা আন্দাজ করা গেলো কতটা ছোট এই অ্যাটোসেকেন্ড, কিন্তু ছবি তোলা যাবে কি করে?
বিজ্ঞানীরা উপায় বের করলেন – আলোর ঝলকানির সাহায্যের, বিজ্ঞানে যাকে বলে পালস্। কিন্তু কী করে তৈরি করা যাবে এই পালস্? সাধারণত দুটো ফোটন কণার ব্যতিচারের মাধ্যমে খুবই ক্ষুদ্র ক্ষণের এই পালস তৈরি করা হয়। এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির নাম ‘রিকনস্ট্রাকশন অফ অ্যাটোসেকেন্ড বিটিং বাই ইন্টারফারেন্স অফ টু ফোটন ট্রানজিশন (Reconstruction of attosecond beating by interference of two-photon transitions)‘ বা সংক্ষেপে ‘র্যাব্বিট (RABBITT)’। সহজ করে বললে ব্যাপার টা এমন, ভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের লেজার আলো যখন একে অপরের ওপর এসে পড়ে, (মানে ব্যতিচারের সময়) যখন দুটো একই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো যারা কিনা আবার একই দশায় (বিজ্ঞানের ভাষায় সুসংহত আলো বা কোহেরেন্ট লাইট) আছে তাদের গঠন মূলক ব্যতিচারের দরুন একটা ঝলকানি বা পালস্ তৈরি হয়, কিন্তু এদের স্থায়িত্ব খুব কম, বড়জোর এক ফেমটোসেকেন্ড (এক সেকেন্ডকে একের পিঠে পনেরো টা শূন্য দিয়ে ভাগ করলে তবেই ফেমটো সেকেন্ড পাওয়া যায় বা এক সেকেন্ডের ১০−১৫ ভাগের এক ভাগ)। কিন্তু ইলেকট্রনের ছবি নিতে গেলে আরো হাজার গুণ ক্ষুদ্র সময়ের পালস্ দরকার। তবেই পৌঁছানো যাবে অ্যাটোর ঘরে। সেজন্যে ফেমটো সেকেন্ডের পালস্ কে পাঠানো হয় নিষ্ক্রিয় গ্যাসের চেম্বারে। ওই পালস্ তখন গ্যাসের বাইরের কক্ষে থাকা ইলেকট্রনকে ধাক্কা দিলে চার ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে। এই চারটি সম্ভাব্য ঘটনার মধ্যে কেবল মাত্র একটি ক্ষেত্রেই উচ্চ কম্পাঙ্কের অ্যাটোসেকেন্ড ফ্ল্যাশ, বা পালস্ তৈরি হয়। প্রথম ফেমটো সেকেন্ড পালস ইলেক্ট্রনকে ধাক্কা দিয়ে অন্য কক্ষে পাঠিয়ে দেয় ক্ষণিকের জন্য। তারপর আবার সে নিম্ন শক্তির কক্ষে ফিরে এলে কিছু শক্তি তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণ (অবশ্য উচ্চ কম্পাঙ্কের) হিসাবে নির্গত করে। আবার হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা সূত্রানুযায়ী সেই বিকিরণের স্থায়িত্ব খুবই অল্প। এভাবেই জন্ম নেয় মানব ইতিহাসের সবচেয়ে কম সময়ের ঝলকানি – ‘অ্যাটোসেকেন্ড পালস্’।
বিজ্ঞানীরা অনেক দিন থেকেই চেষ্টা করে আসছেন খুবই ক্ষুদ্র সময়ের পালস্ বা ফ্ল্যাশ তৈরি করতে। কিন্তু অ্যাটোসেকেন্ড পালস্ তৈরি আজ থেকে তিন দশক আগে পর্যন্ত একরকম অসাধ্য ছিল। সেই অসাধ্য সাধন করেছেন অ্যান লহুইলিয়ে, পিয়ের অগস্টিনি, এবং ফেরেঙ্ক ক্রাউজ নামক তিন পদার্থবিদ। ছুটন্ত ইলেকট্রনের গতিবিধি ধরতে পেরেছেন তাঁরা। বিজ্ঞানে এ এক অভাবনীয় সাফল্য। স্বীকৃতি স্বরূপ ২০২৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল এসেছে তাঁদের ঝুলিতে। ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক পিয়ের আগোস্তিনি ২০০১ সালে প্রথম ২৫০ অ্যাটোসেকেন্ড বিশিষ্ট পালস্ তৈরি করেন, ঐ বছরেই ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের এক বিজ্ঞানী, ফেরেনৎস ক্রাউস তৈরি করেন ৬৫০ অ্যাটোসেকেন্ড দীর্ঘ পালস্। এঁদের মধ্যে লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আন লুইলিয়ে হচ্ছেন পৃথিবীর ইতিহাসে পঞ্চম নোবেলজয়ী মহিলা পদার্থবিজ্ঞানী।
এবারে আমরা জানবো কীভাবে ইলেকট্রনের ছবি তোলে এই পালস্? ইলেকট্রন আকারে খুবই ছোটো, অ্যাটোসেকেন্ড পালস্ দ্বারা সরাসরি তার ছবি তুলতে পারি ব্যাপারটা এমন নয়। আমরা আইনস্টাইনের ফোটো ইলেকট্রিক ইফেক্ট থেকে জেনেছি, আলোর মধ্যে পর্যাপ্ত শক্তি থাকলে, তা পরমাণুর ইলেকট্রনকে স্থানান্তরিত করতে পারে। অ্যাটোসেকেন্ড ফ্ল্যাশের ক্ষেত্রে এই কাজটাই করা হয়। কোনো একটি অণুতে পর্যায় ক্রমে অ্যাটোসেকেন্ড পালস্ প্রয়োগ করলে তার বৈশিষ্ট্যের কি পরিবর্তন হয়, তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায়। বারংবার পর্যবেক্ষণের পরে ইলেক্ট্রন-গতিবিদ্যা বা ইলেক্ট্রন-ডাইনামিক্স বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়।
এই অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্স বা অ্যাটোফিজিক্সের আরো উন্নতি হলে ইলেকট্রনের গতিবিধি আরো বিস্তারিতভাবে জানতে পারবেন বিজ্ঞানীরা। আরো ভালোভাবে পাওয়া যাবে পরমাণুর হাঁড়ির খবর। জানা যাবে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার গতি প্রকৃতির রহস্য, কারণ এই ইলেক্ট্রন ই তো বিক্রিয়ার মূল কারিগর। এই বিষয়ে বিজ্ঞানের অগ্রগতি হদিশ দেবে বিভিন্ন জটিল ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতির মাঝে মধ্যে উদ্ভট আচরণের । এমনকি আমাদের শরীরের অসংখ্য অনু পরমাণু গুলির ভেতরকার ইলেক্ট্রন গুলো বিভিন্ন সময়ে কেমন আচরণ করে, সে তথ্য ও জানা যাবে বলে আশাবাদী বিজ্ঞানী মহল। সেসব তথ্যের ডানায় ভর করে, অদূর ভবিষ্যতে স্বাস্থ্য বিজ্ঞানে এক বিরাট বিপ্লব আসবে আশা করা যায়।
তথ্যসুত্র:
- Multiple-harmonic conversion of 1064 nm radiation in rare gases. J. Phys. B: At. Mol. Opt. Phys (1988). 21 L31. DOI: 10.1088/0953-4075/21/3/001
- Attosecond metrology. Nature 414, 509–513 (2001). DOI: 10.1038/35107000
- Theory of high-harmonic generation by low-frequency laser fields. Phys. Rev (1994). A 49, 2117. DOI: 10.1103/PhysRevA.49.2117
- “Single-cycle optical control of beam electrons,” Phys. Rev. Lett. 125, 193202 (2020).
- Observation of a Train of Attosecond Pulses from High Harmonic Generation. Science 292, 1689-1692 (2001). DOI:10.1126/science.1059413
- Delay in Photoemission. Science 328, 1658-1662 (2010). DOI: 10.1126/science.1189401
- Photoionization in the time and frequency domain.Science 358, 893-896 (2017). DOI: 10.1126/science.aao7043
- Pree release: The Nobel Prize in Physics 2023
নিয়মিত আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের নিউজলেটারে এবং ফলো করুন আমাদের টেলিগ্রাম, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার এবং ফেসবুক-এ। এছাড়াও যুক্ত হতে পারেন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।
এই নিবন্ধটি Creative Commons Attribution-NoDerivatives 4.0 International License-এর অধীনে লাইসেন্সকৃত। পুনঃপ্রকাশের জন্য পুনঃপ্রকাশের নির্দেশিকা দেখুুন।