সর্বশেষ বিজ্ঞান সংবাদ বিজ্ঞানবার্তা-র গুগল নিউজ চ্যানেলে।
আসিমভের একটা ছোট সায়েন্স ফিকশন গল্প পড়েছিলাম বহু বছর আগে, ফল্ট ইন্টলারেন্ট (Fault-intolerant)। যেখানে গল্পের প্রধান চরিত্র, আব্রাম ইভানভ এমন একটা কম্পিউটার এর সাহায্য নিয়ে লেখা শুরু করে, যে নিজেই প্রুফরিড করতে পারে এবং নিজের ভুল শোধরাতে পারে। অনেকটা বর্তমান সময়ের মাইক্রোসফট ওয়ার্ড কিংবা গ্রামারলির মতো। কিন্তু গল্পের শেষের দিকে দেখা যায়, ঐ কম্পিউটার নিজে নিজেই আব্রাম ইভানভের মত গল্প-উপন্যাস লেখা শুরু করে দিয়েছে। তাই আব্রাম ইভানভ এর প্রশ্ন, সে একজন প্রলিফিক রাইটার হয়েও তাকে এখন লিখতে হবে না, তার কম্পিউটারই সব লিখে দিবে, তাহলে তার আর কাজ কি? যন্ত্র করছে মানুষের ভাবনার কাজ, মননের কাজ।
বেশ কিছু বছর ধরে এআই (AI) বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলেজেন্স-এর প্রভাব ও ব্যবহার সর্বত্র। গবেষণার ক্ষেত্রে যেহেতু লেখার কাজ অনেক, তাই অনেকে লেখার কাজটা আরো সহজ করার লক্ষ্যে বাজারে যে প্রচুর সফটওয়্যার ও ওয়েব সার্ভিস আছে, তাদের সাহায্য নিয়ে থাকে। এইসবের কাজ লেখার ভাষাগত সৌন্দর্য বাড়ানো এবং নির্ভুল করা। কিন্তু বাজারে এখন এমন কিছু সফটওয়্যারের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে যেগুলো আপনার হয়ে লিখে দিবে, আপনাকে শুধু তাকে কোনো কিছু লেখার জন্য নির্দেশ দিলেই হবে। এটাই হচ্ছে দুশ্চিন্তার ব্যাপার। সম্প্রতি, নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি এর “When ChatGPT writes scientific abstracts, can it fool study reviewers?” শীর্ষক প্রবন্ধে এমনই কিছু গবেষণার কাজের ম্যানুস্ক্রিপ্টে OpenAI এর ChatGPT সার্ভিস ব্যাবহারের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা খুবই অনৈতিক। কেননা গবেষণার কাজ করা হয় কোনো এক্সপেরিমেন্ট কিংবা প্রতিষ্ঠিত কোনো মডেলের ব্যবহারের মাধ্যমে। এবং গবেষণা পত্র লেখা হয় সেই গবেষণার কাজ মানুষের কাছে প্রকাশ করার জন্য। যখন তা প্রকাশিত হয়, তখন যারা এই কাজের সাথে সরাসরি জড়িত কিংবা ইন্টেলেকচুয়ালি অবদান রেখেছে, তাদের নাম লেখক তালিকায় উল্লেখ থাকে। এখন কেউ যদি ঐ গবেষণা পত্রের ভাষার ব্যাকরণ (গ্রামার) চেক করে কিংবা লেখকদেরকে মোটিভেট করে, তাহলে কিন্তু তার নাম লেখক তালিকায় থাকবে না, হয়ত গবেষণা পত্রের স্বীকৃতি সেকশনে থাকতে পারে। কেননা গবেষণা পত্রের ভাষার ব্যাকরণ চেক মাইক্রোসফট ওয়ার্ড কিংবা গ্রামারলি অনেকদিন ধরেই করে আসছে, তাহলে লেখক তালিকায় এই সফটওয়্যার গুলোর নাম আসতো কিংবা চা-কফির নাম আসতো আমাদের সবসময় মোটিভেট করার জন্য।
এখন আসা যাক ChatGPT কিংবা অন্যান্য এআই এর গবেষণা পত্রে ব্যবহারের বৈধতা ও নৈতিকতা নিয়ে। একজন গবেষক যখন তার গবেষণার কাজ লেখায় প্রকাশ করতে চায়, তখন তাকে অনেক দিকে খেয়াল রাখতে হয়। প্রথমত, তাকে তার গবেষণার ফল বর্ণনা করতে হয় বিভিন্ন মডেলের সাহায্যে। অতঃপর তাকে লিটারেচার রিভিউ করে আগের প্রকাশিত গবেষণা পত্রের ডাটা ও জ্ঞানের সাথে তার নিজের গবেষণার ফলের তুলনা-মূলক আলোচনা লিখতে হয়। অবশেষে একটি গবেষণা পত্র লেখা শেষ হলে তা প্রকাশের জন্য প্রাসঙ্গিক জার্নালে তা জমা দেওয়া হয় প্রকাশের জন্য। জার্নাল এর এডিটর তা বিভিন্ন রিভিউওয়ার এর কাছে পাঠায় এবং রিভিউওয়াররা ঐ গবেষণাপত্র বিভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করে। তারা মূলত দেখে গবেষণা কাজটি কি প্রাসঙ্গিক, গবেষণা পত্রের ভাষা কি লেখকের নিজস্ব, যে সকল গ্রাফ আছে তারা কি ঠিকভাবে তৈরি করা হয়েছে, স্ট্যাটিস্টিক্যাল এনালাইসিস কি সঠিক মডেল ব্যবহার করে করা হয়েছে, ভাষাগত ব্যবহার তথ্য বর্ণনার ক্ষেত্রে, আগের কাজের সাথে তুলনার বৈধতা কিংবা কাজের মৌলিকতাসহ আরোও অনেক কিছু। সম্প্রীতি এই রিভেউ প্রসেস নিয়েও অনেক অসচ্ছতা দেখা যাচ্ছে। যাদের রিভিউ করার কোনো যোগ্যতা নেই, তারাই শতশত ম্যানুস্ক্রিপ্ট রিভিউ করছে। এইসব অযোগ্য রিভিউওয়াররা ভুল রিভিউ করে ভুলে ভরা গবেষণা পত্রকে প্রকাশ করার জন্য গ্রিন সিগন্যাল দিয়ে দিচ্ছে। তবে আজকের বিষয় এটা না, এই বিষয়ে পরবর্তী কোনো লেখায় বিস্তারিতভাবে লিখব।
মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। রিভিউওয়ারদের মতামতের উপর ভিত্তি করেই গবেষণা পত্রের প্রকাশের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ প্রকাশিত হবে নাকি প্রত্যাখ্যান হবে। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে লেখা গবেষণা পত্রে তো মৌলিকতা নেই, তারা হাজার-হাজার লেখা বিশ্লেষণ করে লিখেছে, তাই তা প্রকাশ করা পুরোপুরি অনৈতিক হবে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে এইসকল লেখায় বৈজ্ঞানিক ভুলের আধিক্যতা থাকবে. কেননা, এআই সফটওয়্যারগুলো তাদের কাছে উপলব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে লেখা গুলো লিখছে, কিন্তু আমাদের সামগ্রিক জ্ঞানের অনেকটুকুই এখনো কাগজের বইয়ের অন্তর্ভুক্ত, যেখানে AI এর এক্সেস নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কেউ যদি এআই এর সাহায্যের নকল গবেষণা পত্র কিংবা মৌলিক লেখা লিখে, তাহলে কিভাবে একজন রিভিউওয়ার তা ধরবে। এখানেও এআই এর লেখা চেক দেয়ার বিভিন্ন প্লাজারিজম সফটওয়্যারের সাহায্য নিতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এআই কি এআই কে ধোঁকা দিতে পারে না? সেটারও ভালোই সম্ভাবনা আছে। তাই এই ক্ষেত্রে সমাধান নৈতিকতা। একমাত্র নৈতিকতাই পারে আমাদেরকে যেকোনো মূল কাজের স্বীকৃতি দিতে। কেননা, অনেক দুষ্কৃত গবেষক ও বিজ্ঞানী আছে, যারা গবেষণার কাজ না করেই ভুয়া ও ভুল গবেষণা পত্র লেখে, এবং তা প্রকাশও করে। তারা দেশ সেরাও হতে পারে! এমন দুষ্কৃত গবেষকের সংখ্যা অগণিত। এই জন্যই গবেষণার কাজের জন্য একজন দক্ষ সুপারভাইসরের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক। যে সুপারভাইসর ক্রমাগত একজন গবেষকের সাথে তার কাজের বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করবে এবং ঠিকমত তার কাজের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবে। সাথে সাথে তাকে নৈতিকতার শিক্ষা দিবে। কেননা, গবেষণা পত্র প্রকাশের ক্ষেত্রে এমন অনুশীলন করা না হলে ভবিষ্যতে আমরা অনেক ল্যাব ছাড়া ( কাজ না করে!), দেশ সেরা (বিখ্যাত জার্নালে গবেষণার পত্র প্রকাশ করে!) বিজ্ঞানী দেখতে পাবো। হয়তো ইতিমধ্যে এমন অনেকে গবেষকেই আছে! যাদেরকে তাদের গবেষণার কাজ জিজ্ঞেস করলে, তারা শুধু এই বলে উত্তর দিবে, “দেখুন আমি এই এই বিখ্যাত জার্নালে গবেষণার কাজ প্রকাশ করেছি!” কিংবা, “আই’ম ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ১০+ 😜”।
নিয়মিত আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের নিউজলেটারে এবং ফলো করুন আমাদের টেলিগ্রাম, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার এবং ফেসবুক-এ। এছাড়াও যুক্ত হতে পারেন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।
এই নিবন্ধটি Creative Commons Attribution-NoDerivatives 4.0 International License-এর অধীনে লাইসেন্সকৃত। পুনঃপ্রকাশের জন্য পুনঃপ্রকাশের নির্দেশিকা দেখুুন।