সর্বশেষ বিজ্ঞান সংবাদ বিজ্ঞানবার্তা-র গুগল নিউজ চ্যানেলে।
গতবছর অর্থাৎ ২০২৪ সালের শুরুর দিকে জার্মান ভিত্তিক ম্যাক্স প্লাঙ্ক সোসাইটি মহাকাশের একটি বিস্তারিত এক্স-রে মানচিত্র প্রকাশ করে। মূলত ম্যাক্স প্লাঙ্ক সোসাইটির একদল বিজ্ঞানী রাশিয়া-জার্মানীর যৌথভাবে তৈরি উচ্চ প্রযুক্তির ইরোসিটা (eROSITA) এক্স-রে টেলিস্কোপ ব্যবহার করে মহাজাগতিক অবজেক্টের বিপুল পরিমাণ তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে মহাবিশ্বের একটি আংশিক এক্সরে ম্যাপ তৈরি করেন। এই কসমিক মানচিত্রে প্রায় ৯ লক্ষের অধিক মহাজাগতিক অবজেক্ট স্থান পেয়েছে। যার মধ্যে প্রায় ৭ লাখেরও বেশি সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল এবং প্রায় ১২ হাজার গ্যালাক্সি ক্লাস্টার গ্রুপ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
তাছাড়া আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথে অবস্থান করা ১,৮০,০০০ এক্সরে নির্গমনকারী নক্ষত্র, পালসার, সুপারনোভা অবশিষ্টাংশ, বাইনারি নক্ষত্র এবং অন্যান্য এক্সরে উৎসের মতো কিছু রহস্যময় কসমিক অবজেক্ট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই মহাকাশ জরিপ বা গবেষণার মাধ্যমে মহাজাগতিক কাঠামোর মধ্যে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের গঠন ও বৈশিষ্ট্য জানার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। তাছাড়া এই সার্ভেটি সুবিশাল মহাকাশ সংক্রান্ত বিস্তৃত ঘটনা সম্পর্কেও নতুন অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। যা ভবিষ্যতে মহাকাশ নিয়ে কার্যকর গবেষণায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারবে বলে আশাবাদী বিজ্ঞানীরা।
এই দীর্ঘ মেয়াদি এবং উচ্চাভিলাসী মহাকাশ গবেষণায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং নতুন আবিষ্কারগুলির মধ্যে একটি হল যে, ৪২ মিলিয়ন আলোকবর্ষেরও বেশি (আকাশগঙ্গার দৈর্ঘ্যের ৪০০ গুণেরও বেশি) জুড়ে দুটি ছায়াপথের ক্লাস্টারকে সংযুক্ত করে এমন একটি বিশাল “ফিলামেন্ট” বা গরম গ্যাসের সেতুর অস্তিত্ব স্থান পেয়েছে। বিজ্ঞানীরা এই গরম গ্যাসের সেতু বা ফিলামেন্টটি-কে মহাজাগতিক জালের একটি অংশ বলে মনে করেন। আর তাদের গবেষণা মতে, এই অতি রহস্যময় গ্যাসের বিশাল সুপার হাইওয়ে-তে লুকিয়ে থাকতে পারে ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি মতো অদৃশ্য শক্তি।
ম্যাক্স প্লাঙ্ক সোসাইটির বিজ্ঞানীরা ‘ইরোসিটা অল স্কাই সার্ভে’ নামের একটি প্রকল্পের আওতায় গত ২০১৯ সালের ১২ই ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ১১ই জুন পর্যন্ত এই বিপুল পরিমাণ মহাজাগতিক অবজেক্টের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেন। এর পাশাপাশি মহাকাশ নিয়ে এই দীর্ঘ মেয়াদি গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে বিজ্ঞানীরা ভূমি ভিত্তিক ইরোসিটা (eROSITA) টেলিস্কোপের অতি সংবেদনশীল (০.২-২ keV) সেন্সর দ্বারা মহাকাশে স্ক্যানিং প্রায় ১৭০ মিলিয়নের অধিক উচ্চ শক্তির ফোটন কণার অস্তিত্ব শনাক্ত করেন। যা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো পর্যন্ত নিবিড়ভাবে গবেষণা করে যাচ্ছেন।
এদিকে মহাকাশে ছড়িয়ে থাকা লক্ষ লক্ষ গ্যালাক্সি ক্লাস্টার গ্রুপের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী গ্যাসের এই সংযোগ সেতুকে মহাজাগতিক জালের অংশ বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, মহাকাশের এই গ্যাসের ফিলামেন্ট বা সুপার কসমিক হাইওয়ে প্রতিনিয়ত তার আশপাশের সব গ্যালাক্সিকেই কিছু না কিছু দিয়ে যাচ্ছে। এর মানে হলো যে, বিশাল আকারের ছায়াপথের গ্রহ-নক্ষত্র সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এই রহস্যয় কসমিক গ্যাসের ভাণ্ডার। মহাকাশের সুবিশাল আকারের ফাঁকা স্থান কিংবা ভয়েড অঞ্চলের সুনির্দিষ্ট অবস্থানও চিহ্নিত করছে এটি।
এই মহাকাশ এক্সরে ম্যাপিং প্রজেক্ট সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে, এই প্রকল্পের প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করে ইতোমধ্যেই প্রায় ২ শতাধিকের অধিক গবেষণা পত্র প্রকাশ হয়েছে। যার মধ্যে আবার প্রায় ৫০টি বা তার অধিক রিসার্চ পেপারস আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিভিন্ন বিজ্ঞান ও গবেষণা ভিত্তিক জার্নালে জমা দেয়া হয়েছে। যদিও এসব রিসার্চ পেপারস ইরোসিটা (eROSITA) টেলিস্কোপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের খুবই সামান্য পরিমাণ অংশ নিয়েই আলোচনা করা হয়েছে। আর এই প্রকল্পের ডাটা বিশ্লেষণ করে এখনো পর্যন্ত নতুন নতুন রিসার্চ পেপারস বা গবেষণাপত্র প্রকাশ হচ্ছে।
মহাকাশে এক্সরে ম্যাপিং প্রজেক্টের সাথে সম্পৃক্ত মহাকাশ বিজ্ঞানীরা আশা করেন যে, ইরোসিটা (eROSITA) টেলিস্কোপের মাধ্যমে তাদের অনুসন্ধান এবং গবেষণামূলক কার্যক্রম চলমান থাকবে। এই উচ্চপ্রযুক্তির এক্সরে টেলিস্কোপটি স্পেকট্রাম-রনজেন্ট-গামা (এসআরজি) স্পেস অবজারভেটরিতে আছে। বর্তমানে জার্মানি এবং রাশিয়া যৌথভাবে পরিচালনা করছে এই টেলিস্কোপটি। ম্যাক্স-প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল ফিজিক্স (MPE) এর প্রযুক্তিগত সহায়তায় এবং নেতৃত্বে এটি ডিজাইন ও তৈরি করা হয়েছে।
ক্রেডিট: Dietl et al. (2024)
ইরোসিটা (eROSITA) টেলিস্কোপ হলো একটি অতি সংবেদনশীল এক্সরে টেলিস্কোপ। যা কিনা সুবিশাল মহাকাশের আকাশের গভীর অঞ্চলের তীক্ষ্ণ চিত্র (~0.2-8 keV) শক্তি পরিসরে পৌঁছে দিতে সক্ষম। এই টেলিস্কোপে সাতটি অভিন্ন Wolter-1 মিরর মডিউল ইনস্টল করা হয়েছে। যা প্রতিটি মডিউলে প্রয়োজনীয় সংবেদনশীলতা পূরণের জন্য ৫৪টি নেস্টেড মিরর শেল রয়েছে। তাছাড়া এর পাশাপাশি XMM-Newton pn-CCD প্রযুক্তির উপর ভিত্তি করে MPE দ্বারা একটি নতুন ডিটেক্টর সিস্টেম/সেন্সর তৈরি করা হয়েছে।
এটি গত ২০১৯ সালের ১৩ই জুলাই রাশিয়ার বাইকোনুর কসমোড্রোম ল্যান্ড বেসড স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় এবং এল-২ বিন্দুর চারপাশে একটি হ্যালো কক্ষপথে স্থাপন করা হয়। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত এটি তার ক্যালিব্রেশন এবং পারফরম্যান্স যাচাইকরণ (Cal-PV) প্রোগ্রামটি পরিচালনা করেছে। এই এক্সরে টেলিস্কোপ দ্বারা ইতোমধ্যেই মহাকাশের একটি বিশাল অঞ্চল ব্যাপী জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। যেখানে প্রতি ছয় মাসে একবার সমগ্র মহাজাগতিক গোলক ম্যাপ করা হয়।
আর ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ধরনের আটটি সর্ব-আকাশ চার্ট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। আসলে এই টেলিস্কোপটিকে মহাবিশ্বের বৃহৎ স্কেল কাঠামো অধ্যয়ন করার জন্য এবং তার পাশাপাশি ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জিসহ মহাজাগতিক মডেলগুলি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ, শনাক্ত কিংবা পরীক্ষা করার উপযোগী করেই ডিজাইন করা হয়েছে। এটি কয়েক মিলিয়ন সক্রিয় গ্যালাকটিক নিউক্লিয়ার নমুনা শনাক্ত করবে বলে আশা করছেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। যার মধ্যে স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট উভয় ধরনের কসমিক অবজেক্ট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
–––
- The SRG/eROSITA all-sky survey: First X-ray catalogues and data release of the western Galactic hemisphere. Astronomy & Astrophysics (2024).
DOI: 10.1051/0004-6361/202347165 - eROSITA Publications and Telegrams
নিয়মিত আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের নিউজলেটারে এবং ফলো করুন আমাদের টেলিগ্রাম, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার এবং ফেসবুক-এ। এছাড়াও যুক্ত হতে পারেন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

এই নিবন্ধটি Creative Commons Attribution-NoDerivatives 4.0 International License-এর অধীনে লাইসেন্সকৃত। পুনঃপ্রকাশের জন্য পুনঃপ্রকাশের নির্দেশিকা দেখুুন।