সর্বশেষ বিজ্ঞান সংবাদ বিজ্ঞানবার্তা-র গুগল নিউজ চ্যানেলে।
গবেষণার কাজ জার্নালে প্রকাশের প্রচলন শুরু হয়েছে ১৬৬৫ সালে ফ্রান্সে প্রথম বৈজ্ঞানিক জার্নাল “Journal des sçavans” (জার্নাল অফ দ্য লার্নড) এর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। একই বছর, লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি “Philosophical Transactions of the Royal Society” এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করে। যা বর্তমানে বিশ্বের দীর্ঘতম চলমান বৈজ্ঞানিক জার্নাল। এই জার্নালগুলোকে প্রাথমিকভাবে মূলত বিজ্ঞানীদের তাদের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং তত্ত্বগুলোকে একে অপরের সাথে এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের সাথে যোগাযোগ করার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।
রয়্যাল সোসাইটি ক্রিস্টোফার রেন, রবার্ট বয়েল, জন উইলকিন্সসহ আরো কিছু বিশিষ্ট বিজ্ঞানী এবং বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার পৃষ্ঠপোষক ছিল ব্রিটিশ রাজ পরিবার (ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় চার্লস)।[1] প্রাথমিকভাবে হেনরি ওল্ডেনবার্গ রয়্যাল সোসাইটির সচিব ছিলেন, যিনি ১৬৬২ থেকে ১৬৭৭ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। তিনি নিজে ছিলেন একজন জার্মান ধর্মতত্ত্ববিদ এবং দার্শনিক, যিনি সেইসময়কার বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা কাজের আদান-প্রদান, তা ভিন্ন ভাষায় অনুবাদ ও প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। যার জন্য তাকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পিয়ার রিভিউয়ের পথিকৃৎ বলা হয়।
তিনি যোগাযোগের এমন একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন, যা তখনকার বিজ্ঞানীদের তাদের অনুসন্ধানিক গবেষণা, ধারণার ব্যাখ্যা এবং আবিষ্কারগুলোকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে খুবই সাহায্য করেছিল। ওল্ডেনবার্গের নির্দেশনায় “Philosophical Transactions” জার্নালে ইংরেজি এবং ল্যাটিন উভয় ভাষায় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, যেহেতু ল্যাটিন সেই সময়ে বিজ্ঞ ও গবেষকদের যোগাযোগের আন্তর্জাতিক ভাষা ছিল। যার ফলে বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা ভাষার বাধা ছাড়াই তাদের গবেষণার ফলাফল সহজেই সবার মাঝে প্রকাশ করতে শুরু করে দেয়। জীববিজ্ঞানী টমাস হেনরি হাক্সলি “Philosophical Transactions” জার্নালের দুইশ বছর পূর্তির কিছু পরে ১৮৬৬ সালে বলেছিলেন যে, “১৬৬৫ সাল থেকে মুদ্রিত সমস্ত বই, কেবলমাত্র “Philosophical Transactions of the Royal Society” জার্নালগুলো ব্যতীত, যদি ধ্বংস করে দেয়া হয়, তবেও সেই সময়ের মধ্যে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক অগ্রগতির অসম্পূর্ণ রেকর্ড যদিও অপ্রয়োজনীয়ভাবে অসম্পূর্ণ থাকে, তবুও জ্ঞানের বেশ ভাল অংশই অক্ষত থাকবে।“[2]
বৈজ্ঞানিক জার্নাল প্রকাশনা সময়ের সাথে সাথে আরও উল্লেখযোগ্যভাবে বিকশিত হয়েছে, যা প্রযুক্তির পরিবর্তন, বৈজ্ঞানিক শাখার বৃদ্ধি এবং পিয়ার রিভিউয়ের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বর উপর নির্ভর করে এগিয়েছে। বৈজ্ঞানিক জার্নাল প্রকাশনার শুরুর বছরগুলোতে, জার্নালগুলো সচরাচর স্বতন্ত্র বিজ্ঞানী কিংবা গবেষকদের ছোট ছোট দল দ্বারা পরিচালিত হত। তারা প্রাথমিকভাবে সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং ধারণাগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতো। এই জার্নালগুলো সাধারণত তাদের গঠন এবং বিষয়বস্তুতে ছিল অপরিপক্ক এবং কঠোর পিয়ার রিভিউ প্রক্রিয়ার প্রচলন ছিল কম, যা বর্তমান বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
বৈজ্ঞানিক জার্নাল প্রকাশনার আগে, যে সকল বিজ্ঞানী তাদের কঠিন সাধনার গবেষণার কাজ বইয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন, যেমন, নিকোলাস কোপার্নিকাসের On the Revolutions of the Celestial Spheres (১৫৪৩) বই। বইটি মহাবিশ্বের একটি সূর্যকেন্দ্রিক মডেলের প্রস্তাবণা করেছিল, যেখানে সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলো তার চারপাশে প্রদক্ষিণ করে। এই প্রস্তাবণা কোপার্নিকাসের সময়ের পূর্বে গৃহীত ভূকেন্দ্রিক মডেলের বিপরীত ছিল, যেখানে পৃথিবী ছিল কেন্দ্রে। তার এই কাজ ছিল যুগান্তকারী, কিন্তু তিনি শুধুমাত্র গাণিতিক গণনা এবং জ্যোতির্বিদ্যাগত পর্যবেক্ষণ হিসাবে তার ধারণাগুলো উপস্থাপন করেননি। তার পরিবর্তে, তিনি দার্শনিক প্রেক্ষাপটের মাধ্যমে তার যুক্তি নির্মাণ করেছিলেন, তার ধারণাগুলোকে সমর্থন করার জন্য তিনি শাস্ত্রীয় দর্শন এবং ধর্মতত্ত্বের উপর নির্ভর করেছিলেন।
কোপার্নিকাস গ্রীক দার্শনিক পিথাগোরাসের দ্বারা খুবই প্রভাবিত ছিলেন, যিনি মহাবিশ্বের গাণিতিক ক্রমে বিশ্বাস করতেন এবং স্বর্গের পরিপূর্ণতার প্লেটোনিক ধারণা দ্বারাও প্রভাবিত ছিলেন। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে সূর্যকেন্দ্রিক মডেলটি পৃথিবীকেন্দ্রিক মডেলের থেকেও অধিক মার্জিত এবং গাণিতিকভাবে সঠিক, সেই সাথে এটি মহাবিশ্বের সামঞ্জস্য এবং পরিপূর্ণতাকে আরও ভালভাবে প্রতিফলিত করে। আমার মূল লক্ষ্য কোপার্নিকাসের গবেষণার কাজ বর্ণনা করা নই, বরং সেই সময়ের বিজ্ঞানীদের নিজস্বতা নিয়ে। এখন তা নিয়েই বলব।
প্রাথমিক যুগের বিজ্ঞানীরা তাদের বৈজ্ঞানিক ধারণাগুলোকে সমর্থন করার জন্য দার্শনিক এবং ধর্মতাত্ত্বিক ধারণাগুলো ব্যবহার করে দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের গবেষণা কাজ ব্যাখ্যা করতেন ডায়ালগের সাহায্যে। যার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ সক্রেটিসের নীতিশাস্ত্রের উপর প্লেটোর ডায়ালগগুলো।3 এর কারণ হল আধুনিক যুগের আগে, শাস্ত্রীয় (Classical) যুগে (খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক) বিজ্ঞান ও দর্শন ওতপ্রোতভাবে ঘনিষ্ঠ ছিল, এবং বিজ্ঞানীরা নিজেদেরকে মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কে দার্শনিক অনুসন্ধানের প্তহেই হাঁটতেন। যা তাদের কাজের মধ্যে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই।
উদাহরণস্বরূপ, গ্যালিলিও গ্যালিলি, বস্তুর গতি সম্পর্কে তার ধারণাকে সমর্থন করার জন্য দার্শনিক যুক্তি ব্যবহার করেছিলেন, সেখানেও তিনি ডায়ালগের সাহায্যেই তার যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। তিনি অ্যারিস্টটলের দর্শন এবং জড়তার ধারণার উপর নির্ভর করে এই যুক্তিতে পৌঁছান যে, বস্তুগুলো গতিশীল থাকবে যদি না কোনো বাহ্যিক শক্তি দ্বারা কাজ করা হয়, এই ধারণাটি, যা সেই সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিল, কেননা তার গ্রন্থে তিনি গণিতের (মূলত জ্যামিতি) ব্যবহার করেছেন দক্ষতার সাথে।
সময়ের সাথে সাথে বিজ্ঞান আরও বিশেষায়িত এবং পেশাদার হয়ে উঠেছে, ফলে দার্শনিক বা ধর্মতাত্ত্বিক বিবেচনার উপর কম জোর দিয়ে আরও বিশেষায়িত এবং প্রযুক্তিগত বৈজ্ঞানিক লেখার দিকে বিজ্ঞানীরা ঝুঁকছে। ফলে ন্যাচারাল ফিলসফি বা প্রাকৃতিক দর্শন, পরিবর্তিত হয়ে পদার্থবিদ্যায় রূপান্তরিত হয়েছে। যা যেমন বৈজ্ঞানিক শাখাকে বর্ধিত বিশেষীকরণ করেছে, তেমনি তা বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রযুক্তিগত বিবরণের উপর অধিকতর আলোকপাত করেছে। তা ছাড়াও, বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রচারের মাধ্যম হিসাবে বৈজ্ঞানিক জার্নালের প্রসার এই উদ্দেশ্যে অবদান রেখেছে। কেননা, জার্নালগুলোতে কঠোর বিন্যাস এবং ছকে বাঁধা নিয়ম থাকে, যা বৃহত্তর দার্শনিক বিবেচনার চেয়ে প্রযুক্তিগত নির্ভুলতাকে অগ্রাধিকার দেয়। সেই সাথে সাথে ছকে বাঁধা এই সকল গবেষণাপত্রে লেখকদের নিজস্বতা চরমভাবে অনুপস্থিত। কারণ, এখানে গবেষকরা একটা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ভাবতে থাকে।
যদিও চলতি প্রবণতাটি বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে আরও সুনির্দিষ্ট এবং কঠোর করতে সাহায্য করেছে, এবং পাঠক খুব সহজে তার প্রয়োজনীয় সঠিক তথ্য গ্রহণ করতে পারছে এইসব ফর্ম্যাটেড গবেষণাপত্র থেকে। কেননা ফর্ম্যাটেড গবেষণাপত্রের অনেক সুবিধা আছে। যেমন, এতে সামগ্রিক গবেষণা কাজের সুপাঠ্যতা বাড়াতে সাহায্য করে। সঠিকভাবে সাজানোর কারণে পাঠকরা দ্রুত তথ্য খুঁজে পেতে পারে এবং গবেষণার কাঠামো বুঝতে পারে। আবার, প্রাথমিক যুগের বিজ্ঞানীরা দার্শনিকদের দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে বোঝার জন্য নিজেদের অন্তর্দৃষ্টি, এবং অনুমানের উপর নির্ভর করত। তার বিপরীতে, বর্তমানের ফর্ম্যাটেড গবেষণাপত্রগুলো সঠিক এবং নির্ভরযোগ্য ফলাফলের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়, যা পরীক্ষামূলক প্রমাণ এবং কঠোর পদ্ধতির উপর নির্ভর করে। যদিও এখনো কিছু বিজ্ঞানী বিজ্ঞানের প্রাচীনতম দার্শনিক পদ্ধতিতে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন, যেখানে প্রযুক্তিগত নির্ভুলতার পাশাপাশি নিরপেক্ষ দার্শনিক এবং নৈতিক বিবেচনাকে আরও গুরুত্ব দেওয়া হবে।
তথ্যসূত্র:
- Boorstin, D. J. The discoverers; Vintage, 2011.
- Noah Moxham.350 years of the scientific journal: celebrating the anniversary of Philosophical Transactions. The Guardian. Science blog network, 2015
- Griswold Jr, C. L. Platonic writings/Platonic readings; Penn State Press, 2010.
নিয়মিত আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের নিউজলেটারে এবং ফলো করুন আমাদের টেলিগ্রাম, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার এবং ফেসবুক-এ। এছাড়াও যুক্ত হতে পারেন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।
এই নিবন্ধটি Creative Commons Attribution-NoDerivatives 4.0 International License-এর অধীনে লাইসেন্সকৃত। পুনঃপ্রকাশের জন্য পুনঃপ্রকাশের নির্দেশিকা দেখুুন।