সর্বশেষ বিজ্ঞান সংবাদ বিজ্ঞানবার্তা-র গুগল নিউজ চ্যানেলে।
বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে সম্পর্ক আদি কাল থেকেই। দর্শনকে পরিপূর্ণ বিজ্ঞান না বলা হলেও, বিজ্ঞানের ব্যবহারের ক্ষেত্রে দর্শনের প্রয়োগ সর্বত্র। গবেষণাপত্রের নানান জালিয়াতির এই সময়ে, একটা দার্শনিক প্রশ্ন এসেই যায়, বিজ্ঞান কি পুরোপুরি গবেষণা পত্রের উপর নির্ভরশীল?
অবশ্যই গবেষণা পত্রের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা একজন গবেষক সঠিক পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে এবং আনুষঙ্গিক নানা বিজ্ঞানীর মতামতের ভিত্তিতে গবেষণাপত্র রচনা করেন। ফলে, দুষ্কৃতিকারী কোনো গবেষকের ভুল গবেষণাপত্র প্রকাশের দায় কোনো ভাবেই সত্যিকার বিজ্ঞানীদের উপর বর্তাই না। কিন্তু ইচ্ছাকৃত কিংবা অনিচ্ছাকৃত ভুলে পরিপূর্ণ গবেষণাপত্রের ছড়াছড়ি কোনদিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে? ইচ্ছাকৃত ভাবে বানানো তথ্যের উপর ভিত্তি করে ভালো জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশের নজিরও কম না। এই ক্ষেত্রে জ্যান হেন্ড্রিক শনের জালিয়াতি খুবই চর্চিত একটা ঘটনা। যেখানে তিনি সিঙ্গেল মলিকিউল সেমিকন্ডাক্টর তৈরির দাবি করেছিলেন। কিন্তু পড়ে যখন অন্যান্য গবেষকরা শনের ঐ এক্সপেরিমেন্ট পুনরায় চালনা করে এবং তার প্রকাশিত ও দাবি করা ফলাফল পায় না, তখন সবাই সন্দেহ প্রকাশ করে শনের গবেষণার প্রতি।1 পরে তদন্তে জানা যায় যে, শন তার গবেষণার তথ্য জাল এবং ম্যানিপুলেট করেছিল। ফলে তার প্রকাশিত ঐসব গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এই ঘটনার আগে, তিনি পদার্থবিজ্ঞানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরষ্কারেও ভূষিত হয়েছিলেন (এমনকি তাকে নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনয়নের গুঞ্জন উঠেছিল!), যা সব পরে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।2
সম্প্রতি Retraction Watch (একটি ব্লগ, যা বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রত্যাহার এবং সম্পর্কিত বিষয়গুলোর উপর প্রতিবেদন করে) ইতোমধ্যে প্রায় ৩৯,০০০ এর মতো গবেষণাপত্র প্রত্যাহারের বিবরণ করেছে, যা রীতিমতো ভয়াবহ গবেষণা মহলে। বর্তমান সময়ে Retraction Watch এর কর্মকাণ্ড বেশ আলোচনায় আসছে টুইটার (বর্তমানে এক্স)-এর বদৌলতে। এমনও হয়েছে, কোনো একজন গবেষক তার লেখা প্লেজিয়ারিজম হয়েছে এমন দাবি জার্নাল কর্তৃপক্ষকে করেও সদুত্তর না পেয়ে Retraction Watch এর টুইটারে জানালে, সেটারও সমাধান হচ্ছে। কিংবা একজন গবেশনাপত্রের পাঠক একটি লেখায় এমন অসংলগ্নতা পায়, ফলে পরবর্তীতে ঐ গবেষণাপত্রটি প্রত্যাহার করা হয়। সম্প্রতি ঘটা এই চমকপ্রদ ঘটনাটি বলার লোভ সামলাতে পারছি না।
যখন গবেষকরা ডাটা সংগ্রহ করে, অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে তাদের ডাটাগুলি সঠিক কি-না তা নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ করতে হয়। ‘টি-টেস্ট’ ও একটি পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণ, যা একটি নির্দিষ্ট ভেরিয়েবলে দুটি গ্রুপের মাধ্যমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আছে কিনা তা নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়। ঐ পাঠক দেখতে পান, তার পাঠকৃত গবেষণাপত্রে ‘টি-টেস্ট’ উল্লেখ থাকলেও, চিত্রে তা নেই, বরং তার বদলে যে জায়গায় ‘Error Bar’ এর অবস্থান থাকে, সেখানে ‘T’ দেয়া আছে (নিচের ছবিতে)। হ্যাঁ, তিনি ‘টি-টেস্ট’ করেছেন, শুধু ‘T’ অক্ষর দিয়ে! পরিসংখ্যানগত কোনো সূত্র দিয়ে না।
এতে এটা স্পষ্ট, গবেষণাপত্রটির লেখকরা ‘টি-টেস্ট’ এর সম্বন্ধে জানলেও, তা কিভাবে করতে হয় জানতেন না এবং এর প্রয়োগও জানতেন না। এই ছাড়াও ঐ পেপারে আরো অনেক রকম ভুলে পরিপূর্ণ ছিল, আমি ঐদিকে যাচ্ছি না (আপনারা মূল পোস্টে গেলে তা জানতে পারবেন, A paper used capital T’s instead of error bars. But wait, there’s more!).3
আমার প্রশ্ন জার্নালের এডিটর এবং রেভিউয়াররা কিভাবে এই মারাত্মক ভুল গুলো উপেক্ষা করলো? এতে এটা স্পষ্ট যে, এই রকম জার্নালের ভুল গবেষণাপত্র প্রকাশের উদ্দেশ্য কেবলমাত্র মুনাফা বাড়ানো। কেননা, এই ধরনের জার্নাল গুলো টাকার বিনিময়ে খুব কম সময়ে গবেষণাপত্র প্রকাশের আশ্বাস দেয় এবং তা তারা করেও। ফলশ্রুতিতে মানহীন গবেষণাপত্রের সংখ্যা প্রকোপহারে বাড়ছে, এবং পরিকল্পনা করে এইসব পেপারের সাইটেশনও বাড়ানো হচ্ছে। আর যখন এইসব অসংলগ্নটা প্রকাশ পায়, তখন খবর হয়, “Hindawi এবং Wiley পিয়ার রিভিউ রিং গুলোর সাথে যুক্ত ৫০০ টিরও বেশি গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করছে” কিংবা “Elsevier ৫০০ টি পেপার প্রত্যাহার করছে মানহীন পিয়ার রিভিউর জন্য”। এতে বোঝা যাচ্ছে, জার্নাল কর্তৃপক্ষ সত্যিকারের বিশেষজ্ঞ রিভিউয়ারদেরকে না দিয়ে অনভিজ্ঞ মানুষদেরকে এই জটিল কাজ দিচ্ছে বেশি-বেশি পেপার প্রকাশ করে অধিক মুনাফার লক্ষ্যে। কেননা একজন বিশেষজ্ঞ রিভিউয়ার একই কাজ করতে সময় বেশি নেন এবং পেপারের গুণগত মান যাচাই করে তা রিজেক্ট বা একসেপ্ট করেন।
অন্যদিকে অনভিজ্ঞ রিভিউয়ার গবেষণার মান নির্ধারণ করতে পারে না, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মান যাচাই না করেই একসেপ্টেন্স রিপোর্ট দিয়ে দেয়। এতে বিজ্ঞানের ক্ষতি হলেও, তাদের কিছু আসে যায় না। পরবর্তী সময়ে কোনো কারণে একটি গবেষণাপত্র প্রত্যাহার হলে, জার্নাল কর্তৃপক্ষ তাদের রিভিউ প্রক্রিয়ার উপর ঐ দায় চাপিয়ে দেয়। তাই বিশেষজ্ঞ রিভিউয়ার দিয়ে যেসব জার্নাল রিভিউ করায়, সে সকল জার্নালকে ভালো ইন্ডেক্সিং দেয়া হোক, এবং শুধুমাত্র ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর দিয়ে জার্নাল গুলোকে যাতে বিবেচনা না করা হয়।
তথ্যসূত্র:
- Reich, E. S. The rise and fall of a physics fraudster. Physics World 2009, 22 (05), 24.
- Labini, F. S. Science and the economic crisis: Impact on science, lessons from science; Springer, 2016.
- https://retractionwatch.com/2022/12/05/a-paper-used-capital-ts-instead-of-error-bars-but-wait-theres-more/
নিয়মিত আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের নিউজলেটারে এবং ফলো করুন আমাদের টেলিগ্রাম, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার এবং ফেসবুক-এ। এছাড়াও যুক্ত হতে পারেন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

এই নিবন্ধটি Creative Commons Attribution-NoDerivatives 4.0 International License-এর অধীনে লাইসেন্সকৃত। পুনঃপ্রকাশের জন্য পুনঃপ্রকাশের নির্দেশিকা দেখুুন।