সর্বশেষ বিজ্ঞান সংবাদ বিজ্ঞানবার্তা-র গুগল নিউজ চ্যানেলে।
ফিজিওলজি বা মেডিসিনে নোবেল বিজয়ী ফ্রান্সিস ক্রিকের বই, “অফ মলিকিউলস অ্যান্ড মেন (১৯৬৬)”1, যার শিরোনাম জন স্টেইনবেকের “অফ মাইস অ্যান্ড মেন (১৯৩৭)” উপন্যাসের নাম থেকে অনুকরণ করা হয়েছে। বইটির উদ্দেশ্য ছিল “Vitalism বা প্রাণবাদ” ধারণাকে খণ্ডন করা। মূলত প্রাণবাদ একটি দার্শনিক এবং ছদ্মবৈজ্ঞানিক ধারণা ছিল, যা এটা বলে যে, জীবন্ত প্রাণীদের একটি অনন্য জীবনী শক্তি বা প্রাণশক্তি (আত্মা) রয়েছে যা শুধু শারীরিক বা রাসায়নিক আইন দ্বারা সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা সম্ভব না। প্রাণবাদের ধারণাটি প্রাচীন গ্রিক দর্শনে খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে এটি আত্মার ধারণার সাথে যুক্ত করা হয়। প্রাণবাদীরা বিশ্বাস করেন যে জীবিত এবং নির্জীব জিনিসের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, যা একটি অত্যাবশ্যক শক্তির উপস্থিতির কারণে জীবন্ত প্রাণীকে সজীব করে এবং তাদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দেয়। উনিশ শতকে জীববিজ্ঞানের বিকাশে প্রাণবাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকলেও, বিশ শতকের গোড়ার দিকে জীববিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে প্রাণবাদের ধারণাও খণ্ডন করা হয় বিভিন্নভাবে।
প্রাণবাদের এই ধারণা খণ্ডন করার লক্ষ্যে, ফ্রান্সিস ক্রিক তার সময় থেকে জৈবিক অগ্রগতির কিছু উজ্জ্বল উদাহরণ উপস্থাপন করেছেন তার বইতে। বইটি তিনটি অংশে বিভক্ত, যেখানে প্রথম অংশে প্রাণশক্তির মানদণ্ড সম্পর্কে। দ্বিতীয় অংশ গ্রন্থের মূল আলোচ্য বিষয় বহন করে, যা কীভাবে কোষের কাজ, ডিএনএ প্রতিলিপি, আরএনএ উৎপাদন, এনজাইম, প্রোটিন ইত্যাদির প্রমাণ বর্ণনা করা হয়। শেষ অংশটিতে প্রমাণসহ প্রাণশক্তিকে বাতিল করা হয় এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার উল্লেখ করা হয়।
অনেক মানুষের মনে প্রাণবাদ বিদ্যমান। তারা জীবিত এবং নির্জীব বস্তুর মধ্যে পার্থক্যকে এক ধরনের প্রাণশক্তি বলে মনে করে, যা তারা ব্যাখ্যা করতে পারেনি। এর কারণ হল আদিকালে লোকেরা যদি কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারে তবে তারা ভাইটালিজমের উল্লেখ করত। ভাইটালিজমের উপর ভিত্তি করে এমন সাধারণ প্রশ্নগুলোর মধ্যে রয়েছে: মায়ের গর্ভে মানব-ভ্রূণ কীভাবে গঠন করে? কীভাবে আমাদের হাত কিংবা অন্যান্য অঙ্গ প্রতিবার ঠিক একই আকৃতি ধারণ করে? কীভাবে প্রতিটি কোষ তার জোড়া কোষ চিনতে পারে? এই প্রশ্নগুলোর উপর ভিত্তি করে, সেইসময়ের মানুষের কাছে সমঝোতা ছিল যে, “শুধু প্রাণবাদই এদের উত্তর দিতে পারে” যা একটি অজানা শক্তি এবং এই শক্তি উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর একমাত্র উত্তর!
ফ্রান্সিস ক্রিক ব্যাখ্যা করেছেন যে, আমরা আদিকালে ভাইটালিজমের উপর নির্ভর করেছি কারণ আমরা আমাদের বিদ্যমান জ্ঞান দিয়ে ঘটনাটি ব্যাখ্যা করতে পারিনি। তবে, যদি আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে জ্ঞান পাই এবং সেগুলোকে একত্রিত করি, তাহলে আমাদের কাছে বর্তমানে আরো ভাল ব্যাখ্যা রয়েছে। লেখক আরো উল্লেখ করেছেন, কিছু বিজ্ঞানী অনিচ্ছাকৃতভাবে একটি ভুল ব্যাখ্যা দেন (হয়ত তারা ভাইটালিস্ট, কিন্তু তারা তা স্বীকার করেন না), যা পরবর্তীতে উন্নত বিজ্ঞান দ্বারা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। লেখক ব্যঙ্গাত্মকভাবে এই বইয়ে বলেছিলেন, “যখন সত্য দরজায় আসে, তখন প্রাণবাদ জানালা দিয়ে উড়ে যায়!”।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে, লেখক উন্নত আণবিক জীববিজ্ঞানের সাগরে ডুব দিয়েছেন। তিনি একটি ব্যাকটেরিয়া কোষ (E. coli) এবং তার আন্তঃকোষীয় সম্পর্কের গঠনের ব্যাখ্যা দেন। পরবর্তী অংশে তিনি জিনের গঠন, জেনেটিক তথ্য, ডারউইনের বিবর্তন, প্রোটিন সংশ্লেষণ, এনজাইমগুলোর প্রক্রিয়া, ভাইরাসের জীবন, ডিএনএ প্রতিলিপি, জীবনের আণবিক ভিত্তি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে সেলুলার যন্ত্রপাতির গভীরতার অনুসন্ধান করেন। তিনি ডিএনএ এর সংশ্লেষণের পূর্বাভাসও দেন। তার মতে, বৈজ্ঞানিক তথ্যের প্রাপ্যতার সাথে, আণবিক ঘটনাগুলো সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। লেখকের মতে, প্রাণবাদ আণবিক স্তরে বর্জিত কারণ প্রতিটি ঘটনা বা প্রতিক্রিয়ার নিজস্ব প্রক্রিয়া রয়েছে এবং এটি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে ক্রমান্বয়ে গবেষণার মাধ্যমে।
বইয়ের শেষ অধ্যায়ের শুরুতে লেখক আণবিক দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেছেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ফ্রান্সিস ক্রিক যৌথভাবে জেমস ওয়াটসন ও মরিস উইলকিনস এর সাথে ডিএনএর গঠন ব্যাখ্যা (১৯৫৪) করার জন্য নোবেল পুরস্কার (১৯৬২) পান।2 ফ্রান্সিস ক্রিক তার এই বইয়ে, জীবনের শুরু থেকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের (যা এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে প্রাণীরা তাদের পরিবেশের সাথে ভালোভাবে খাপ খাইয়ে নেয়, ফলে তাদের বেঁচে থাকার এবং প্রজনন করার সম্ভাবনা বেশি থাকে, এবং তাদের সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের সন্তানদের কাছে প্রেরণ করে ডিএনএর মাধ্যমে) ঘটনাও উল্লেখ করেছেন, জার ফলে আরো জটিল জীব সৃষ্টি হয়েছে। তিনি সমন্বয়ের মাধ্যমে একক অণু থেকে যৌগ গঠনের উপর তার মত প্রসারিত করেন যে, গবেষণার সীমা ঠেলে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সবকিছুই সম্ভব। বর্তমানে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার অ্যালগরিদমের সাহায্যে, জটিল সমস্যাগুলোর দ্রুত ডাটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে, বিজ্ঞানীরা প্রচুর তথ্যের ব্যবহার করছে বিজ্ঞানকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য, যা আগে অর্জনযোগ্য ছিল না। লেখক কিছু বৈজ্ঞানিক ঘটনাও উপস্থাপন করেছেন তার নিজের চূড়ান্ত ভাবনার সাথে যে, বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য, আরো গবেষক প্রয়োজন এবং জীববিজ্ঞানের নানা ব্যাখ্যা দাড় করাতেও। সেই সাথে সাথে সঠিক জ্ঞান অর্জনের জন্য আরো তথ্যের প্রয়োজন, যা প্রাণবাদকে বিশ্রাম দিতে সক্ষম হবে!
আধুনিক সময়ে, প্রাণবাদ প্রায় মৃত। কেবল কয়েকজনই প্রাণবাদের নীতির উপর নির্ভর করে, কারণ তাদের সামনে প্রতিনিয়ত ঘটা বিভিন্ন ঘটনার জন্য ভালো ব্যাখ্যার অভাব রয়েছে। প্রতিটি সম্ভাব্য জৈবিক ঘটনার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা থাকলে, প্রাণবাদের বলে কোনো শব্দ থাকবে না। “অফ মলিকিউলস অ্যান্ড মেন” একটি বেশ উপভোগ্য বই। এই বইটিতে ভাইটালিজমকে খণ্ডন করার অনেক ভাল উদাহরণ রয়েছে।
তবুও, বিকল্প চিকিৎসার কিছু প্রবক্তা প্রাণবাদের ধারণাগুলো গ্রহণ করে চলেছেন, এবং পরামর্শও দিচ্ছেন যে মানবদেহে একটি অনন্য জীবনী শক্তি রয়েছে যা বিভিন্ন থেরাপি এবং চিকিৎসার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। বিভিন্ন ধর্মে, আত্মার পরিশুদ্ধির নানা প্রক্রিয়াও বেশ জনপ্রিয়। এমনকি আত্মার ওজন মাপারও চেষ্টা করা হয়েছে। সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হলো, ১৯০৭ সালে চিকিৎসক ডানকান ম্যাকডুগাল দ্বারা পরিচালিত ২১ গ্রাম পরীক্ষা, যেখানে তিনি দাবি করেছিলেন যে, তিনি মৃত্যুর আগে এবং পরে রোগীদের ওজন পরিমাপ করে মানুষের আত্মার ওজন নির্ণয় করেছিলেন।3 যদিও, ঐ পরীক্ষাটি ছোট নমুনার আকার এবং বৈজ্ঞানিক কাঠামোর অভাবের জন্য সমালোচিত হয়েছিল। যাইহোক, প্রাণবাদের ধারণাগুলো বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত না এবং তাদের দাবির স্বপক্ষে খুব কম প্রমাণই রয়েছে।
বিদ্র : প্রোফেসর জন সান্তালুসিয়ার ‘মেটাবোলিজম’ কোর্সের সম্পূরক হিসেবে বর্তমান পর্যালোচনাটি লেখা হয়েছিল ২০১৮ সালে। লেখকের নিজস্ব ধর্মানুভূতি এবং বিশ্বাস এখানে প্রাধান্য পায়নি।
তথ্যসূত্র:
- Crick, F. Of molecules and men. 1966.
- Crick, F. H. C.; Watson, J. D.; Wilkins, M. H. F. Nobel Prize in Physiology or Medicine, 1962. HARRISONS PRINCIPLES OF INTERNAL MEDICINE 2001, 1, 762-762.
- Ishida, M. Rebuttal to Claimed Refutations of Duncan MacDougall’s Experiment on Human Weight Change at the Moment of Death. Journal of Scientific Exploration 2010, 24 (1).
নিয়মিত আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের নিউজলেটারে এবং ফলো করুন আমাদের টেলিগ্রাম, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার এবং ফেসবুক-এ। এছাড়াও যুক্ত হতে পারেন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।
এই নিবন্ধটি Creative Commons Attribution-NoDerivatives 4.0 International License-এর অধীনে লাইসেন্সকৃত। পুনঃপ্রকাশের জন্য পুনঃপ্রকাশের নির্দেশিকা দেখুুন।