সর্বশেষ বিজ্ঞান সংবাদ বিজ্ঞানবার্তা-র গুগল নিউজ চ্যানেলে।
২০১৯ সালের প্রথমদিকে শুরুহয় করোনাভাইরাস বা SARS-CoV-2 ভাইরাসের সংক্রমণ এবং ২০২০ সালের শুরুতে এটি মহামারী রূপ নেয়। এ ভাইরাস সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই ভাবতে পারেননি যথাসময়ে এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি করা সম্ভব হবে। কিন্তু অবিশ্বাস্য ভাবে অনেক কম সময়ে বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করতে সক্ষণ হন। প্রথম সফল ভ্যাক্সিনগুলি ছিলো এমআরএনএ ভ্যাক্সিন। এই এমআরএনএ ভ্যাকসিনের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ক্যারিকো ও ওয়াইজম্যানের আবিষ্কার।
ভ্যাকসিনে বা টিকা নির্দিষ্ট জীবানুর প্রতি আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যেরকম প্রতিক্রিয়া দেয় ঠিক সেরকম প্রতিক্রিয়াকে উদ্দীপিত করে যা পরবর্তী সময়ে ঔ নির্দিষ্ট জীবানুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শরীরকে আগে থেকে প্রস্তুত রাখতে সাহায্য করে। পোলিও, হাম, পীতজ্বর সহ কিছু রোগের ভ্যাকসিন তৈরিতে মৃত বা দুর্বল ভাইরাস এবং ভাইরাসের অংশ অনেক আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৯৫১ সালে, ম্যাক্স থিলার পীতজ্বরের ভ্যাকসিন তৈরির জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ভাইরাসের জেনেটিক কোড অন্য একটি নিরীহ ভাইরাসে প্রবেশ করিয়েও তৈরি করা হয় ভ্যাকসিন। কিন্তু এই পদ্ধতিতে ভ্যাকসিন তৈরি করতে অনেক সময়, গবেষণা এবং অর্থের প্রয়োজন হয়।
সাম্প্রতিক আণবিক জীববিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য, সম্পূর্ণ ভাইরাসের পরিবর্তে ভাইরাসের পৃথক-পৃথক উপাদানের উপর ভিত্তি করে ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে। ভাইরাসের জেনেটিক কোডের অংশ (সাধারণত ভাইরাসের পৃষ্ঠে পাওয়া প্রোটিন এনকোডিং) ভাইরাস প্রতিরোধী প্রোটিন তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়। উদাহরণ হল হেপাটাইটিস বি ভাইরাস এবং হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV) ভ্যাকসিন। এছাড়া, ভাইরাল জেনেটিক কোডের অংশ একটি নিরীহ বাহক ভাইরাসে স্থানান্তরিত করে তা দিয়ে ভ্যাকসিন তৈরি করা যেতে পারে, যেমন ইবোলা।
ক্রেডিট: Mattias Karlén/The Nobel Committee for Physiology or Medicine
আমাদের দেহকোষে জেনেটিক কোড হিসেবে আছে ডিএনএ। এই ডিএনএ থেকে আবার তথ্য বহন করে নিয়ে যায় মেসেঞ্জার আরএনএ, যাকে সংক্ষেপে বলা হয় এমআরএনএ (mRNA)। এই এমআরএনএ থেকে নির্দেশনা নিয়ে তৈরি হয় দেহের প্রয়োজনীয় প্রোটিন।
১৯৮০ এর দশকে, ইন ভিট্রো ট্রান্সক্রিপশন (In Vitro Transcription) নামে কোষ ছাড়াই এমআরএনএ উৎপাদনের কার্যকর পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছিল। কিন্তু তৈরিকৃত এই এমআরএনএ আবার সহজেই নষ্ট হয়ে যায়। এই এমআরএনএ ব্যবহার করে ভ্যাক্সিন তৈরিরও বেশ কিছু প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে কিন্তু এগুলোর মারাত্মক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তার ওপর, ইন ভিট্রো ট্রান্সক্রাইবড এমআরএনএ নিজেও দেহে প্রদাহ বা জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করার মতো ঘটনা ঘটায়। ক্লিনিকাল উদ্দেশ্যে mRNA প্রযুক্তির বিকাশের উৎসাহ তাই প্রাথমিকভাবে সীমিত ছিল।
তবে এত সকল বাধা-বিপক্তিও হাঙ্গেরির জীবরসায়নবিদ ক্যাতালিন ক্যারিকোকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তিনি ঠিকই এমআরএনএনির্ভর চিকিৎসা প্রযুক্তি আবিষ্কারের চেষ্টা করে গেছেন। ১৯৯০ দশের শুরুতে তিনি যখন ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভ্যানিয়ায় সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছিলেন, তখন তাঁর নতুন সহকর্মী হিসেবে যোগ দেন ইমিউনোলজিস্ট ড্রু ওয়াইজম্যান। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ডেনড্রাইটিক কোষ নিয়ে। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর শরীরে প্রতিরক্ষাব্যবস্থার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই কোষ। নতুন ধারণা দ্বারা উদ্বুদ্ধ, ক্যারিকো ও ওয়াইজম্যান একসঙ্গে সহজেই এমআরএনএ ভ্যাকসিন তৈরির পথে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন।
ক্যারিকো এবং ওয়েইসম্যান লক্ষ্য করেন যে ডেনড্রাইটিক কোষগুলি ভিট্রো ট্রান্সক্রাইবড এমআরএনএকে একটি বহিরাগত পদার্থ হিসাবে চিহ্নত করে ধ্বংশ করার সময় এই প্রদাহ বা জ্বালাপোড়া সৃষ্টি হয়। কিন্তু দেহের ভেতরে তৈরি এমআরএনএর ক্ষেত্রে এই সমস্যা হয় না। তারা এই সমস্যার পেছনের কারণ খুঁজতে লাগলেন।
আরএনএ তে চারটি নিউক্লিওটাইড থাকে, A, U, G ও C। এগুলো থেকে যখন ডিএনএ তৈরি হয়, তখন ডিএনএতে থাকে A, T, G ও C। দেহে তৈরি এমআরএনএ-তে কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন আসে। ল্যাবে তৈরি এমআরএনএ-তে এগুলো নেই। এরকম বিভিন্ন রাসায়নিক পরিবর্তন গবেষণাগারে তৈরি এমআরএনএ-তে ঘটিয়ে সেগুলো ডেনড্রাইটিক কোষের সঙ্গে কীরকম প্রতিক্রিয়া ঘটায়, ক্যারিকো ও ওয়াইজম্যান সেটা দেখতে চেষ্টা করলেন। তাঁরা দেখলেন, গবেষণাগারে তৈরি এমআরএনএ-তে কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন আনলে তারা আর ডেনড্রাইটিক কোষের সঙ্গে কোনো প্রতিক্রিয়া ঘটায় না, ফলে এমআরএনএগুলো আর নষ্ট হয়ে যায় না। তখন এই এমআরএনএ থেকে তৈরি হয় প্রোটিন, যা মূল ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে প্রস্তুত করে তুলতে পারে। দেহকোষ কীভাবে এমআরএনএর বিভিন্ন রূপকে চিনতে পারে এবং তার বিপরীতে প্রতিক্রিয়া জানায় তা খুব ভালো করে জানার বোঝার এটাই ছিলো আমাদের সেই প্রথম ঝলক। কারিকো এবং ওয়েইসম্যান অবিলম্বে বুঝতে পেরেছিলেন যে এমআরএনএর থেরাপি হিসাবে ব্যবহার করার জন্য তাদের আবিষ্কারের গভীর তাৎপর্য রয়েছে। তাদের এই গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলগুলি ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, যা কিনা কোভিড-১৯ মহামারীর পনের বছর আগে।
ক্রেডিট: Mattias Karlén/The Nobel Committee for Physiology or Medicine
২০০৮ এবং ২০১০ সালে প্রকাশিত আরও গবেষণায়, ক্যারিকো এবং ওয়েইসম্যান দেখিয়েছেন যে বেস পরিবর্তনের সাথে উৎপন্ন এমআরএনএ ডেলিভারি অপরিবর্তিত mRNA এর তুলনায় প্রোটিন উৎপাদনকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে। প্রভাবটি প্রোটিন উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে এমন একটি এনজাইমের সক্রিয়করণ হ্রাসের কারণে হয়েছিল। তাদের আবিষ্কারের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে বেস পরিবর্তন প্রদাহজনক প্রতিক্রিয়া হ্রাস করে এবং প্রোটিন উৎপাদন বৃদ্ধি করে।
তাঁদের এই আবিষ্কারের পর ২০১০ থেকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এমআরএনএ ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ শুরু করে। প্রথমে জিকা ও সার্স নিয়ে কাজ শুরু হলেও ২০২০ সালে করোনা মহামারীর সময়ে বায়োএনটেক ও মডার্না খুব দ্রুত বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে যাওয়া এই মহামারীর ভ্যাকসিন তৈরির কাজ শুরু করে। এই দুই ভ্যাকসিন ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে অনুমোদন পায়।
তাঁদের এই আবিষ্কার এমআরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অন্যান্য রোগের ভ্যাকসিন তৈরির নতুন দ্বার খুলে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভবিষ্যতে এমআরএনএ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্যান্সার চিকিৎসার কাজও হতে পারে।
উল্লেখ্য, বিভিন্ন পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে SARS-CoV-2-এর বিরুদ্ধে আরও বেশ কয়েকটি ভ্যাকসিনও তৈরি করা হয়েছিল এবং একসাথে, বিশ্বব্যাপী ১৩০০ কোটিরও বেশি কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ডোজ দেওয়া হয়েছে।
———
Suppression of RNA Recognition by Toll-like Receptors: The impact of nucleoside modification and the evolutionary origin of RNA. Immunity 23, 165–175 (2005). DOI: 10.1016/j.immuni.2005.06.008
Incorporation of pseudouridine into mRNA yields superior nonimmunogenic vector with increased translational capacity and biological stability. Mol Ther 16, 1833–1840 (2008). DOI: 10.1038/mt.2008.200
Incorporation of pseudouridine into mRNA enhances translation by diminishing PKR activation. Nucleic Acids Res. 38, 5884–5892 (2010). DOI: 10.1093/nar/gkq347
নিয়মিত আপডেট পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের নিউজলেটারে এবং ফলো করুন আমাদের টেলিগ্রাম, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার এবং ফেসবুক-এ। এছাড়াও যুক্ত হতে পারেন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে।

এই নিবন্ধটি Creative Commons Attribution-NoDerivatives 4.0 International License-এর অধীনে লাইসেন্সকৃত। পুনঃপ্রকাশের জন্য পুনঃপ্রকাশের নির্দেশিকা দেখুুন।